সঞ্চয়পত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া ও মধ্যবিত্ত


‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’। এটা তিন দশক আগের একটি সরকারি প্রচারণা ছিল। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, এমনকি ব্যাংক পত্রপত্রিকায় সঞ্চয়-সংক্রান্ত প্রণোদনা দিতে এ স্লোগান রাখত তাদের বিজ্ঞাপনের শিরোনামে। এটা করতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হতো নিয়মিত। উদ্বুদ্ধকরণ সভাও হতো জেলা সদরসহ গুরুত্বপূর্ণ জনপদে। সেসব সভায় সঞ্চয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়াও থাকতেন জনপ্রতিনিধি ও সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সভাগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চয় কীভাবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনজীবনে সহায়ক হতে পারে, তা আলোচনা হতো। অকুস্থলে বিক্রয়ের ব্যবস্থা ছিল বেশ কিছু ধরনের সঞ্চয়পত্র। ধীরে ধীরে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়তে থাকে জনগণের মধ্যে। দেশের অর্থনীতির আকৃতি হয় বড়। সঞ্চয়ের সনাতনী দপ্তর ছিল ডাকঘর।

এরপর আসে জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোর কিছু অফিস। তারাও আবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। পরবর্তী সময়ে সে ব্যাংকের কিছু কিছু শাখাকেও দেওয়া হয় ক্রয়-বিক্রয়ের দায়িত্ব। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও বিক্রি করছে কিছু। এ ছাড়া মেয়াদি আমানত হিসেবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে টাকা রাখার বেশুমার সুযোগ রয়েছে। আর তা রাখে ব্যাংক ছাড়াও নন–ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আশা করা হয়েছিল, ব্যাংকের এসব আমানত বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ঋণদানে কাজে লাগবে। সরকারও প্রয়োজনে ধার নিতে পারবে। আর সরকারি সঞ্চয়পত্রগুলো বিক্রির টাকা বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হবে ধার হিসেবে। তা-ই হচ্ছিল। অবশ্য সে সময়টিতে সরকারি সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য একতরফা কোনো চাপ ছিল না।


আর এখন! বলা হয় নগদ টাকায় ব্যাংকগুলোর ভান্ডার পরিপূর্ণ। বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে না। তাই তারা কমিয়ে দিয়েছে মেয়াদি-সঞ্চয়ীসহ সব আমানতের সুদের হার। আমানতকারীদের বিষয়ে তারা নিরুৎসাহী। জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংক আমানতের গড় সুদের হার ৪.৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে আবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে গত মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৩৯ শতাংশ। তাই খালি চোখে সবাই দেখছেন মেয়াদি বা সঞ্চয়ী আমানতে ব্যাংকে রাখা টাকা কমে যাচ্ছে। আর ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল এ দেশের লাখ লাখ মানুষ। বছর দুই আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে গড়ে শতকরা ২ শতাংশ। তবু সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন হিসেবে সেদিকেই ছুটছেন সরকারি পেনশনার, বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত, অসহায় নারী, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা।

এ সঞ্চয়পত্রগুলো একদিকে সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটানোর নীরব প্রক্রিয়া, অন্যদিকে অনেকটা সামাজিক নিরাপত্তাবলয়। আর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দিলে এর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা যাবেনই-বা কোথায়? সাধারণত তাঁদের আর কোনো উৎস থেকে তেমন কোনো আয় আসে না। এটাকেই নেড়েচেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া গেল। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, বাজেটের পর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো হবে। এমনিতেই বাজেটে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি বৃদ্ধির চাপ এ শ্রেণিকে একইভাবে অতিরিক্ত ব্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। অন্যদিকে ঝুঁকি রয়েছে আয় কমে যাওয়ার। তাহলে দেখার দরকার কেন এমনটা হয় আর এর বিহিতই-বা কী?

ব্যাংকঋণের সুদের হার এক অঙ্কে আনার জন্য এ দেশের ধনিক সম্প্রদায়ের চাপ ছিল গত অর্ধদশক থেকেই। তাদের যুক্তি ছিল এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা পরিচালনা করা যায় না। এ তত্ত্বটি ভুল নয়। আর তাই সেদিকে নজর দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে ব্যাংকমালিক ও শিল্প উদ্যোক্তা বা বড় ব্যবসার মালিক একই শ্রেণির। ব্যাংকগুলোতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ একরূপ নিরঙ্কুশ। আর সাম্প্রতিক একটি আইনি সংশোধনে তা দৃঢ় হয়েছে। ব্যাংক এ তত্ত্ব বাস্তবায়নে নেমে পড়ে। আমানতকারীদের সুদের হার ক্রমান্বয়ে কমে দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। ঋণের সুদও সে শ্রেণির চাহিদা অনুসারে কমেছে।

তবে বিনিয়োগ বেড়েছে কি আশানুরূপ? বরং ব্যাংকগুলো অলস টাকার ওপর বসে আছে বলে হামেশাই শোনা যায়। কমেছে কি খেলাপি ঋণ? তা-ও নয়। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এ সংস্কৃতি সরকারি ব্যাংক ব্যবস্থাকে কাবু করে বেসরকারি ব্যাংকের দিকে প্রসারিত হচ্ছে। তাহলে এ ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত কে বা কারা হলো? বিনিয়োগকারীরা সস্তায় মূলধন বা চলতি ঋণ পাচ্ছেন। ব্যাংক স্প্রেড পর্যাপ্ত। তদুপরি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কেটে নিচ্ছে বিভিন্ন চার্জ। সেগুলোও বর্তমান বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত আবগারি শুল্কের চেয়ে নেহাত কম নয়। সুতরাং তারাও লাভে আছে। একমাত্র নাকাল আমানতকারী। সুতরাং ব্যাংককে কেন্দ্র করে যে আমানতকারীরা ছিলেন, তাঁরাও ছুটছেন বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের দিকে।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার গড়ে ১১ শতাংশের কাছাকাছি। তবে আয়কর ইত্যাদি বাদ দিলে মূল্যস্ফীতি থেকে একটু বেশি। সুদের হার আরও কমলে এ নিরাপত্তাবলয়ে যাঁরা আছেন, তাঁরা যাবেন কোথায়, সে প্রশ্নের জবাব নেই। বলা হচ্ছে, সরকারের চাহিদার অনেক বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। এটা সরকারের ঋণ। বেশি সুদে শোধ করতে হয়। কিন্তু যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের সহজ কোনো পন্থা নেই। সরকারকেও ধার নিতে হবে। আগামী অর্থবছরে তা নিতে হবে ১ লাখ ১২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। তার মধ্যে ৪৬ হাজার ৪২০ কোটি টাকা আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে। অবশিষ্ট ৬৫ হাজার ৬৫৫ কোটির জোগান দেবে স্থানীয় উৎস। ব্যাংক কিংবা সঞ্চয়পত্র বিক্রির টাকা থেকে। কম সুদে ঋণ পাওয়ার বাসনায় ব্যাংক খাত থেকে এ পরিমাণ টাকা নেওয়া হলে বেসরকারি আমানতকারীদের সেখান থেকে ধার পাওয়া কষ্টকর হতে পারে।

অন্যদিকে এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৪২ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। হইচই হচ্ছে এটা নিয়ে। তবু সরকারকে ব্যাংক থেকে কিছু ঋণ নিতে হবে। আর সঞ্চয়পত্র খাত থেকে যাবে বড় অংশ। এটার সুদের হার নিরুত্সাহজনক করা হলে মধ্যবিত্তের দুর্দশা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমানতে ভাটা পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। নিকট অতীতেও এমনটা হয়েছিল। শেয়ারবাজারে ছুটেছিলেন সব। সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকে। কেউ কোনোরকমে ফিরে এসেছেন স্বস্থানে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির কার্যত একমাত্র নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে দিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আরও কমানো সব বিবেচনায় অযৌক্তিক হবে।

কিছু অর্থনীতিবিদ ‘এত বেশি’ সুদে সরকার টাকা ধার করুক, এমনটা চান না। তত্ত্বগতভাবে তাঁরা ভুল নন, এটা স্বীকার করব। তবে বৃত্তের বাইরে গিয়ে সমাজব্যবস্থার জটিলতা কিছু ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) বাজেটের টাকা জোগানোর জন্য সঞ্চয়পত্রের বিকল্প খোঁজার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, এ ধরনের উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে বাজেটের অর্থ আহরণের বিষয়টি আর্থিক খাত আধুনিকায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে, বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন করা হয়নি। আইএমএফ আমাদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় সংস্থা। তাদের উপদেশও যতটা সম্ভব মেনে চলতে হবে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে এ সংস্থা কিছু টাকাও ঋণ দেয়। তবে তাদের মতামত প্রণয়নে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষকে কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়, সে প্রশ্ন অনেকের। ভর্তুকি বন্ধ করতে তাদের জেদ ধরা অবস্থানের বিপরীতে আমাদের সরকার না দাঁড়ালে আজকে কৃষির যে সমৃদ্ধি, তা আসত না বলে জনগণের রাজস্ব থেকে তো ঋণখেলাপিদের দায়ও বহন করতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য এমন কিছুটা হলে বেশি কোনো ক্ষতি হবে না। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য এ স্কিম প্রবর্তন করা হয়নি বলে আইএমএফের দাবি ধোপে টেকে না। বরাবরই ঘাটতি মেটানোর জন্য একটি বড় উৎস ছিল সঞ্চয়পত্র।

এটা ঠিক, সঞ্চয়পত্র খাতে সুযোগটির অপব্যবহার করছে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অনুমতি কেন দেওয়া হবে, তা বোধগম্য নয়। আর অধিক আয়ের কিছু লোক একাধিক স্থান থেকে এটা সীমাতিরিক্ত ক্রয় করে মুনাফা লুটছে। ক্রেতার সর্বোচ্চ সীমা যাচাইয়ের সক্ষমতা অধিদপ্তরটির নেই। ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন খুব ব্যয়বহুল বা সময়সাপেক্ষ নয়। অথচ এ-জাতীয় একটি প্রস্তাব দীর্ঘদিন ঝুলে আছে। সেটা দ্রুত বিবেচনায় নেওয়া দরকার। একটি জনবান্ধব কর্মসূচিতে সরকারের কিছু অতিরিক্ত ব্যয় হলেও সব দিক বিবেচনায় একে টিকিয়ে রাখা দরকার।

Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment