বাবা আমি জঙ্গী না ওরা আমাকে ..... পড়ুন বিস্তারিত

সিলেটের আতিয়া মহল থেকে উদ্ধার করা তিন জঙ্গির পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। এদের একজন জেএমবির শীর্ষ নেতা মুসা। বাকি দু’জন মর্জিনা ও কায়সার। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে সংরক্ষিত মুসার ছবির সঙ্গে আতিয়া মহলে নিহত এক জঙ্গির চেহারার মিল পাওয়া গেছে।

এছাড়া সিলেটের পুলিশ কর্মকর্তা মর্জিনা ও কায়সারের লাশ শনাক্ত করেন। মুসা ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করে। মর্জিনা প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়নি। মুসা জিয়ার হাত ধরে জঙ্গিবাদের দীক্ষা নেয়। মর্জিনা তার বড় ভাইয়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গি দলে যোগ দেয়।

সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানায় নিহতদের একজন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। নিহত এক জঙ্গির চেহারার সঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে সংরক্ষিত মুসার ছবির মিল আছে। অভিযানের আগে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে তথ্য ছিল- এ বাড়িতেই মুসা অবস্থান করছে। পুলিশের মতে, মুসা নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা। নব্য জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হওয়ার পর মুসা নব্য জেএমবিকে গোছানোর কাজে হাত দেয়।


কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেন, মৃত এক জঙ্গির চেহারার সঙ্গে মুসার আগের ছবির মিল পাওয়া গেছে। এখন মুসার পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তা মিলিয়ে দেখা হবে।

জানা গেছে, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার এক জঙ্গি আস্তানা থেকে চার মাসের শিশু সন্তানসহ গ্রেফতার করা হয় জঙ্গি মুসার স্ত্রী তিশামণিকে (২২)। ওই আস্তানায় অভিযানের আগেই মুসা পালিয়ে যায়। মিরপুরের রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত মেজর জাহিদের হাত ধরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে মঈনুল ইসলাম মুসা। মুসা উত্তরার লাইফ স্কুলে একসময় শিক্ষকতা করলেও পরে নব্য জেএমবিতে যোগ দিয়েছিল স্ত্রীসহ।

তবে মেধাবী ছাত্র মঈনুলের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার খবরে হতবাক এলাকার মানুষও। গ্রামের মেধাবী ছাত্র মঈনুলকে তারা কেউ মুসা নামে চেনেন না। সেই মঈনুল যে নিউ জেএমবির নেতা মুসা সেটা তারা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছেন। তিশার জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার খবরও একইভাবে জানতে পারেন স্থানীয়রা। গ্রামের সেই সাধারণ মেয়েটি জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে- এটা বিশ্বাসই করতে পারছে না গ্রামের মানুষ।

স্থানীয় গণিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মুসা সম্পর্কে বলেন, ‘ছেলেটা তো খুব মেধাবী ছিল। লেখাপড়ায় খুব ভালো হওয়ায় অনেকেই বলতেন ম্যাজিস্ট্রেট হবে। তার পরিবারও তার ওপর ভরসা করত। কিন্তু মঈনুলের মুসা হওয়ার খবরটা জেনে খুব খারাপই লেগেছে। বিপথগামী হয়ে ছেলেটা এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবে আবার পরিবারকেও হেয় করবে আমরাও ভাবিনি।’

বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের ইউনিয়নটির নাম গণিপুর। এ ইউনিয়নের বুজরুককোলা গ্রামের আবুল কামাল মোল্লার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বড় ছেলে মঈনুল ওরফে মুসা। মুসার মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। কালাম মোল্লার দ্বিতীয় স্ত্রীর আরও তিন সন্তান রয়েছে। সুফিয়া বেগম জানান, পড়ালেখায় ছেলেটার (মুসা) মাথা ভালো ছিল বলে তার ওপর আমাদের অনেক আশা ছিল। এভাবে সে পথ হারাবে এটা আমরা কখনও ভাবিনি। মুসা জঙ্গি হয়ে যাবে একবারও ভাবিনি- আক্ষেপ করে বলেন মুসার মা। সুফিয়া বেগম আরও জানান, মঈনুলের স্ত্রী তিশামণি গর্ভবতী থাকাবস্থায় তিনি একবার ঢাকায় তাদের বাসায় গিয়েছিলেন। তখন তিশা মেজর জাহিদের কথা তাকে বলেছিল। জাহিদ খুব ভালো মানুষ আল্লাহওয়ালা বলেও তার কাছে বর্ণনা দেয় তিশা। কিন্তু সুফিয়ার দাবি, তিনি তখনাও বুঝতে পারেননি তারা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে।

গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। কিন্তু মঈনুল ইসলাম নিয়মিত নামাজও পড়ত না একসময়। বাবা-মা ধর্মাচার পালনে তাকে তাগাদা দিতেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও করত সে। আরও জানা গেছে, বাগমাবার মচমইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মঈনুল মাধ্যমিক ও তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় চলে যায় পড়াশোনা করতে। ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে সে চাকরি নিয়েছিল শিক্ষকতার। বাড়িতে জানিয়েছিল ভালো বেতন। পরিবার থেকে সরকারি চাকরি খোঁজার কথা বলা হলেও মুসা বলেছিল এতেই বেতন ভালো। ঢাকায় প্রাইভেট পড়িয়ে ভালো আয় হবে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি চাকরি পেয়ে বাড়িতে এসে বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী বাসুপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদের মেয়ে তিশামণিকে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে বাড়িতে এসেছিল সে। এরপর জানিয়েছিল বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে বাবার কিছু জমিও বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায়। এরপর আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি পরিবারের সঙ্গে।

মুসার ভাই খাইরুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ যখন বউ নিয়ে বাড়িতে আসে, তখন মঈনুলের আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখেন তারা। ব্যাগভর্তি বইও সঙ্গে ছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলেনি। বাড়ির বাইরে কম যেত। একদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে আর ফোনও করেনি কোনোদিন। আমরা ভাবতাম বিদেশে চলে গেছে।

মঈনুল ওরফে মুসা ও তিশা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভুঁইয়া বলেন, মুসা নামে মঈনুলকে তার গ্রামের লোকজন চেনে না। এটা হতে পারে তার সাংগঠনিক নাম। তবে আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পরপরই নাম দুটি জেলা পুলিশের কাছে আসে। আমরা বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। তবে তারা যেহেতু বেশ কয়েক মাস পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি সেহেতু বিষয়টি অনেকেই জানেন না। তবে এটা ঠিক মুসা বা তিশার পরিবারের কেউ আগে পুলিশকে তাদের নিখোঁজের তথ্য দেয়নি।

সিলেটে জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ নিহত মর্জিনাই বান্দরবানের বাইশারি এলাকার মনজিয়ারা পারভীন। বড় ভাই জহিরুল হক ও তার স্ত্রী আরজিনার কথায় দীর্ঘ ৮ মাস আগে বাড়ি ছেড়েছিল সে। এরপর যোগ দেয় নব্য জেএমবিতে। প্রশিক্ষণ নেয় অস্ত্র চালানো এবং বিস্ফোরক তৈরির। লেখাপড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিও পেরোয়নি সে। বাইশারির কৃষক পরিবারের মেয়ে মনজিয়ারা। তার বাবা পানচাষী নুরুল আলম নাগু। পরিবারের সবার ছোট ছিল সে। ছিল সহজ-সরল প্রকৃতির। এ কারণে পরিবারের সবার আদরেরও ছিল। কিন্তু এই মেয়ে যে ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য, ভয়ংকর জঙ্গি তা কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না। এদিকে আতিয়া মহলে নিহত মর্জিনার লাশ শনাক্ত করতে মঙ্গলবার দুপুর ২টায় সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন মনজিয়ারার পরিবারের সদস্যরা। মনজিয়ারার বাবা নুরুল আলম নাগু ও বড় ভাই জিয়াউল হক সড়কপথে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেন।

গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পশ্চিম আমিরাবাদ ‘সাধন কুঠির’ নামের একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে গ্রেফতার হয় এক জঙ্গি দম্পতি। এরা হল : জহিরুল হক ওরফে জসিম এবং তার স্ত্রী আর্জিনা বেগম ওরফে আকলিমা। একই দিন সাধন কুঠিরের মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে সীতাকুণ্ডের চৌধুরী বাড়ির প্রেমতলার জঙ্গি আস্তানা ‘ছায়ানীড়’ ভবনে অভিযান চালায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযান শেষে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় এক নারীসহ চার জঙ্গির লাশ। নিহত চার জঙ্গির মধ্যে মানজিয়ারার বড় বোন জুবাইদা ইয়াসমিন ও তার স্বামী কামাল এবং তাদের শিশুসন্তানের লাশ ছিল। সীতাকুণ্ডে অভিযান চালানোর সপ্তাহখানেক আগেই মর্জিনা (সাংগঠনিক নাম) সিলেটে অন্য জঙ্গি আস্তানায় চলে যায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম ওরফে নাগুর মেয়ে মনজিয়ারা পারভীন ওরফে মর্জিনা (১৬)। ৮ ভাই ও চার বোনের মধ্যে মনজিয়ারা ছোট। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত সে পড়ালেখা করেছে। পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়া করতে পারেনি। বাবা দরিদ্র কৃষক। পানের বরজ করেই সংসার চালাতেন। মনজিয়ারার ভাই জিয়াউল হক মঙ্গলবার বলেন, গত রমজানের আগে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বড় ভাই জহিরুল হক তার স্ত্রী আর্জিনাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন।

এর এক মাস পর গর্ভবতী ভাবী আর্জিনাকে দেখাশোনার কথা বলে মনজিয়ারাকেও বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রথম এক মাস পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল। জিয়াউল হক আরও জানান, ঘর ছাড়ার পর প্রথম এক মাস যখন ফোনে যোগাযোগ করা হতো তখন মনজিয়ারা বলত তারা ভালো আছে। চট্টগ্রাম শহরে আছে। তাদের জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। একইভাবে বড় ভাই জহিরুল হকও বলত তারা ভালো আছে। ভালো পাত্র পেলে মনজিয়ারাকে বিয়ে দেয়া হবে। জিয়াউল হক জানান, তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে, ভাইবোনসহ পরিবারের এতগুলো সদস্য জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। মর্জিনার বাবা নুরুল আলম জানান, সর্বশেষ সিলেটের আতিয়া মহলে অভিযান শুরুর দ্বিতীয় দিনে তার মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। ওই নম্বরে তিনি (নুরুল আলম) ফোন করলে অপর প্রান্ত থেকে মর্জিনার কণ্ঠ- ‘আমরা বিপদে আছি।’ এর পর ফোনের লাইন কেটে যায়। আর কথা বলতে পারেননি নুরুল আলম।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেফতার জঙ্গি দম্পতির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিলেটের আতিয়া মহলে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে আতিয়া মহলে নিহত দুই জঙ্গির লাশ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেফতার জহিরুলের বোন মনজিয়ারা ওরফে মর্জিনা এবং তার স্বামী কায়সারের লাশ আছে বলে শনাক্ত হয়েছে।-
Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment