হই হই করে ঘরে ঢুকে চার তরুণীকে নির্যাতন


বাসায় কেবল চার তরুণী-কিশোরী, আর তাঁদের মা। রাত তখন ১০টা। বাসার বাইরে চিৎকার, চেঁচামেচি হই হই। ফটক ভাঙার শব্দ। শাবলের আঘাত। এক পর্যায়ে ফটক ভেঙে বাসায় প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা। চালায় শারীরিক নির্যাতন। অস্ত্রের আঘাতে জখমও করে।

মেয়েরা ওই ভয়ঙ্কর রাতটা কখনো ভুলবে না। রাজধানীরই ঘটনা এটি। গত ১৮ এপ্রিল নারিন্দার একটি বাসায় এ ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা গেট ভেঙে বাসায় ঢুকেই হামলা করে চার মেয়ে আর তাদের মায়ের ওপর। মেয়েদের ওড়না আর জামা ধরে টানাহেঁচড়া করা হয়। মেয়েদের একজন শীতল বেগম বাধা দিতে যান। দুর্বৃত্তরা খুর দিয়ে তার কপালে আঘাত করে।

যাওয়ার সময় প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এমনকি বাসা থেকে বের হলে এসিড নিক্ষেপের হুমকিও দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এখন বাসায় বন্দি অবস্থায় রাতদিন কাটছে মেয়েদের।

শীতল এনটিভি অনলাইনকে জানান, একটি সালিশকে কেন্দ্র করে ওই ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিনে শীতলের বাবা নাজিম উদ্দিন হিটলার বাসায় ছিলেন না।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

সালিশ অনুযায়ী সালিশকারী মো. মাসুদের হাতে এক লাখ টাকা তুলে দেন নাজিম উদ্দিন হিটলার। কথা হয়েছিল মাসুদ এ টাকা তুলে দিবেন নাজিমের বোনদের হাতে। নিজের পাঁচবোনের সঙ্গে অর্থ সংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে সালিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ওই টাকা নাজিমের বোনদের হাতে পৌঁছেনি।রাজধানীর নারিন্দার ঘটনা। এ ব্যাপারে মাসুদের কাছে জানতে চাওয়াই কাল হয়েছে নাজিম উদ্দিনের। গত ১৮ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে গেট ভেঙে নাজিমের বাড়িতে ঢুকে দুর্বৃত্তরা। ঘরে থাকা নাজিমের চার মেয়ে আর স্ত্রীর ওপর অমানবিক নির্যাতন করে। ওই পাঁচ নারীকে টানা হেঁচড়া করে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক মেয়েকে খুর দিয়ে আঘাত করে দুর্বত্তরা।এখনো নাজিমের স্ত্রী ও মেয়েরা দুর্বৃত্তদের আতঙ্কে নিজেদের বন্দি হয়ে রয়েছেন ওই বাড়িতে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওয়ারি থানা এলাকায় নারিন্দায় লাল মোহন সাহা রোডে একটি ছোট বাড়ির মালিক নাজিম উদ্দিন। পৈত্রিক সূত্রে বাড়িটি পেয়েছেন। ছয় মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ওই বাড়িতে থাকেন। বাড়ির মালিক হলেও নাজিমের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। মিস্ত্রির কাজ করেন। ওই কাজেই সংসার চলে তাঁর।কথা হয় নাজিমের মেয়ে শীতলের (২০) সঙ্গে। দুর্বৃত্তদের খুরের আঘাতে তাঁরই কপাল কেটে যায়। তিনি জানান, তাঁর বাবা নাজিমের বোন পাঁচজন। ওই পাঁচবোন নাজিমের কাছ থেকে বাড়ির অংশ দাবি করে। অংশ হিসেবে বোনেরা পাঁচলাখ টাকা করে দাবি করে। বিষয়টি সমাধানের জন্য এলাকার মানুষের সাহায্য চান নাজিম। শীতল জানান, সালিশের মাধ্যমে তাঁর পাঁচ ফুপুকে টাকা দেওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর বাবা নাজিম উদ্দিন সালিশকারী ও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি মো. মাসুদের (৪০) হাতে এক লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে দেন।

শীতল বলেন, ‘এই টাকা আমার ফুপুকে দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছু দিন পার হলেও মাসুদ ফুপুদের কাছে টাকা পৌঁছায় নাই। এদিকে আমার ফুপুরাও টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন।’

রাত ১০টার পর হামলা

শীতল বলেন, ‘এ কারণে গত ১৮ এপ্রিল সকালে আমার বাবা মাসুদের কাছে টাকা ফেরত চাইতে যান। মাসুদ আমার বাবাকে গালমন্দ করে একপর্যায়ে মারতে যায়। এ সময় মাসুদের ভাই উজ্জ্বল, মুন্নাসহ আমার বাবাকে প্রাণ নাশের হুমকি দেয়।’শীতল বলেন, ‘এরপর তারা সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে এসে হামলা করার চেষ্টা করে। তখন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসে তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেন। কিন্তু তারা সব কিছু মেনে না নিয়ে রাত ১০টার পর মাসুদ, মাসুদের ছেলে উজ্জ্বলসহ ভাড়া করা সন্ত্রাসী নিয়ে আমাদের বাড়িতে পুনরায় হামলা চালায়। এ সময় তারা শাবল, চাপাতি, বঁটি, দা, খুর ও পিস্তল নিয়ে আসে। আমাদের বাসার মেইন গেট শাবল দিয়ে ভেঙে ভিতরে এসে আমাদের ওপর হামলা করে। এ সময় আমরা চার বোন আর মা ছিলাম। সন্ত্রাসীরা আমাদের ওড়না, জামা কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করে। আমার বোনদের জামা ধরে টানাটানি করার সময় আমি বাধা দিতে যাই। তখন মাসুদ তার হাতে থাকা খুর দিয়ে আঘাত করে। আমরা যদি সবাই নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা না করতাম, তবে আমাদের সবার ইজ্জত চলে যেত। এর পর আমাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

শীতল বেগম ওয়াল্ড ২৪ নিউজ অনলাইনকে আরো বলেন, ‘এই ঘটনার আমরা বিচার চাই, এভাবে নারীদের অত্যাচার করার বিচার চাই। এভাবে মেয়েদের ইজ্জতের ওপর কীভাবে হামলা চালাতে পারে তারা।’

শীতল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের এতগুলো বোন, আমার বাবাকে প্রতিদিন কাজ করে আয় করতে হয়। আমার বাবাকে তারা এখন মেরে ফেলতে চায়, আমারা বোনেরা কেউ রাস্তায় বের হলে তারা এসিড দিয়ে আমাদের চেহারা জ্বালিয়ে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে।’

এ ঘটনার পর নাজিমের স্ত্রী রুমা বেগম ওয়ারী থানায় গিয়ে একটি মামলা করেছেন।

মামলার এজাহার বলা হয়, গত ১৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মো. মাসুদ (৪০), মো. উজ্জ্বল (২৫), মো. মুন্না (৩৮), রিজায় (২৫), আবিরসহ (২০) ৮ থেকে ১০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি অস্ত্র-নিয়ে বাসার মেইন গেটের সামনে এসে সাবল দিয়ে গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে আমার মেয়ে শীতল, আখি বেগম (২৫), স্মৃতি আক্তারসহ (১৮) অন্যদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা মেয়েদের টেনেহেঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। হামলার সময় তাদের মেজবোন আখি বেগমের গলায় থাকা একটি সোনার চেন ছিনিয়ে নেয় তারা। মারধর করে চলে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা থানা পুলিশ বা মোকদ্দমা করলে প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে যায়।

এই ঘটনার বিষয়ে রুমা বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এলাকার সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ মাসুদের কাছে আমার স্বামী টাকা ফেরত চাইতে গেলে তাকে মারধর করতে চায় মাসুদ। আর রাতে আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। সাবল দিয়ে তারা গেট ভেঙে ভিতরে ঢোকে। আমি তাদের বলি তোমরা তো মহল্লার ছেলে এমন করছ কেন। আমার মেয়েদের আমার সামনেই তারা টেনে নিয়ে যেতে ধরেছিল। আমি এই ঘটনার ন্যায্য বিচার চাই। সরকারের কাছে আমি এই সন্ত্রাসীদের বিচার চাই, যাতে এরা আর কোনো জায়গাও মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি না করে।’

রুমা বেগম আরো বলেন, ‘অভিযোগ দেওয়ার পরই পুলিশ তদন্তে এসেছিল। তারা তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে।’

এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে অভিযুক্ত মাসুদ, মুন্না, উজ্জ্বল এদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে এলাকায় তাঁদের পাওয়া যায়নি।

এ দিকে ওই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই কিছু বলতে রাজি হননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান।

ঘটনা সম্পর্কে ওয়ারি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জেহাদ হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঘটনার পর রাতেই অভিযোগ পাবার পর আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। এই ঘটনার পর নির্যাতিত পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়েদের মা রুমা বেগম বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন। ঘটনার পর থেকেই আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment