দেশের তরুণ-তরুণীদের মাঝে বদলে যাচ্ছে প্রেম-আবেগ

হালে বদলাচ্ছে প্রেমের আবেগ। তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। একটা সময় ভালোবাসার ভাষা ছিল চিঠি। চিঠি দিয়েই প্রেম নিবেদন করা হতো। এক সময় প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের হাতে বা শরীরের অন্য কোনো স্থানে ভালোবাসার মানুষের নাম খোদাই করে রাখতো। এতে ঝরতো রক্ত। কিন্তু ভালোবাসার টান শত কষ্টকে ভুলিয়ে দিত। সে সময় লুকোচুরি ছিল প্রবল। কেউ জেনে যাবে, দেখে ফেলবে-এই ভয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা হতো খুব। সেই লুকোচুরি এখন আর নেই। নেই সেই ভয়। এখন প্রকাশ্যেই প্রেম করছেন ছেলেমেয়েরা। অনেক ক্ষেত্রেই তা জানেন মা-বাবা। এমনকি চেনা-অচেনা সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেমিক-প্রেমিকা যৌথ ছবি দিচ্ছেন। একজন-আরেকজনকে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন সম্বোধনে ভালোবাসা প্রকাশ করছেন। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, প্রেম পবিত্র ও সৌন্দর্য্যের নাম। আমরা প্রেমকে পবিত্র হিসেবে দেখে আসছি চিরকাল। প্রেমের জন্য কতো মানুষ জীবন দিয়েছে। কিন্তু এখন আর তা বজায় থাকছে না। প্রেম হারিয়ে যাচ্ছে তা না, তবে পবিত্রতা যেন থাকছে না।


প্রেমের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ছেলেমেয়েতে যখন প্রেম হতো তার উদ্দেশ্য থাকতো বিয়ে করা। বিয়ে হলে তারা সুখী জীবনযাপন করবে। কিন্তু এখন বিয়ে করবো এরকম প্রবল উদ্দেশ্য যেন হারিয়ে গেছে। এখন ছেলেমেয়েরা প্রেম করে ফুর্তি করবে, নাচ-গান করবে, বেড়াতে যাবে- এরকম উদ্দেশ্য নিয়ে। এটাকে আধুনিকতা বলবো না। বলবো আধুনিকতার দোহাই দিয়ে প্রেমের নামে খেলা করা হচ্ছে যেন। আগেকার দিনে প্রেমিক-প্রেমিকারা চিঠি লিখতো। তৃতীয় কারও মাধ্যমে কথা বলতো। এখন মুহূর্তে মুহূর্তে কথা হচ্ছে ফোনে-ইন্টারনেটে। এখন প্রেমের কোনো কিছুই গোপন থাকছে না। প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রকাশ্যেই প্রেম করে বেড়াচ্ছে। কাউকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রেম থাকা উচিত। পবিত্রতা। প্রেমে যেন সম্মান থাকে। অন্তত একটি জীবনকে যেন সুখী-সফল করা যায়। প্রেম সেভাবেই করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এই প্রাক্তন অধ্যাপক। প্রেম করেই বিয়ে করেছেন তাহেরা রিনা। স্বামীর নাম আবদুল মন্নাফ। ত্রিশ বছরের সংসার এই দম্পতির। ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে বিসিসিএস ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়েছেন প্রশাসনে। তাহেরা জানান, নানা কথায়-কাজে অনেক সময় স্বামীর কাছ থেকে কষ্ট পান তিনি। রাগ হয় তখন। কখনও কখনও মনে হয় প্রেম করে বিয়ে করাটাই বুঝি ঠিক হয়নি। কিন্তু প্রেমিক স্বামীর মুখটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে যাই। যেন ভীষণ ভালোবাসায় আকাশের সকল মেঘ উধাও হয়ে যায়। প্রেমের শুরু সম্পর্কে তাহেরা জানান, তাদের বাড়ি মানিকগঞ্জে। মেজো বোন পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবদুল মন্নাফ ছিলেন মেজো বোনের ক্লাসমেট। বিয়ের কয়েক দিন আগেই ঘটে ঘটনাটি। বোনের সঙ্গে বাড়িতে গিয়েছিলেন মন্নাফ। তখন থেকেই ধূমপানের অভ্যাস ছিল তার। মেজো বোনের রুমে তখন আরো বন্ধু-বান্ধবী। মন্নাফ সিগারেট হাতে নিয়ে ঢুকে যান তাহেরার কক্ষে। তখন তাহেরা বাসায় নেই। কক্ষজুড়ে তার বই, ডায়েরি, ছবি। কক্ষে ঢুকে কি করেছিলেন মন্নাফ তা তাহেরা জেনেছিলেন প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার পরে। মন্নাফ ডায়েরির একটি পাতায় সহপাঠী বান্ধবীর ছোট বোনকে লিখেছিলেন ‘তোকে খুব ভালোলাগে। ভালোবাসি।’ তাহেরা যখন বাসায় যান তখন মন্নাফ চলে গেছেন। টেবিলের উপরে ডায়েরিটা পেয়েই ভেবেছেন কেউ হয়তো তা হাতে নিয়েছে। তারপর ডায়েরিটা হাতে নিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে এই লেখায়।

বিস্ময়ে কেঁপে উঠেন। কে এভাবে লিখলো তাকে। একদম বাসায় এসে তার ডায়েরিতে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বড় বোনের ক্লাসমেট ঢুকেছিলেন তার কক্ষে। তারপর মন্নাফের সঙ্গে দেখা হলেই লজ্জা পেতেন খুব। তার থেকে আড়ালে থাকার চেষ্টা করতেন। তবে চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মন্নাফকে তিনিও ভালোবাসেন। একদিন মন্নাফই তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। অনেক কষ্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান। পাশাপাশি বসে বাদাম খেয়েছেন।

তাহেরা বলেন, ‘আমি তখন সিদ্ধেশ্বরীর গার্লস কলেজে পড়ি। তবু এতো লজ্জা করতো যা বলার মতো না। মাথা নিচু করে বসে থাকতাম। দুজনের মধ্যে বসার দূরত্ব থাকতো। সারাক্ষণ আমি তেমন কোনো কথা বলতাম না। মন্নাফই বলে যেতেন। আমি শুনতাম। কখনও কখনও প্রশ্ন করতেন, কি হলো- তুমি কিছু বলছো না যে।’ তারপর বড় বোনের মাধ্যমেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় তাহেরার মা-বাবার কাছে। বিয়ে হয় তাদের।

নব্বইয়ের পরের প্রেমের গল্প সম্পর্কে পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক আদনান আহমেদ জানান, তিনি প্রেম করেছিলেন এক সহপাঠীর সঙ্গে। প্রাথমিক থেকেই এই মেয়েটিকে তার বেশ ভালো লাগতো। যদিও তখনও প্রেম কি জানা হয়নি। এসএসসি পরীক্ষার আগেই প্রেমে জড়িয়ে যান। ভালো ছাত্র হিসেবে ক্লাসমেট ও শিক্ষকদের কাছে আলাদা কদর ছিল আদনানের। ক্লাসমেট এক ছাত্রীকে অঙ্ক করাতেন তিনি। সেখানেই আসা-যাওয়া করতেন আরেক সহপাঠী নাজনীন।

আদনান বলেন, নাজনীনের হাসি তার ভীষণ ভালো লাগতো। তাকে দেখলেই বুকটা কেমন যেন করতো। কথা বলতে গেলে বুকটা কেঁপে উঠতো। সহপাঠী রোজি ছিল আদনান ও নাজনীনের খুব ভক্ত। তার কাছে নাজনীনের প্রশংসা শুনতেন। একইভাবে নাজনীন শুনতেন আদনানের প্রশংসা। নাজনীনের প্রতি তার আকর্ষণের কথা জেনে এক ছেলে সহপাঠী পরামর্শ দিলো চিঠি লিখতে। রাত জেগে কাব্যিক মাধুর্য মিশিয়ে দুই পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটি চিঠি লিখেছিলেন আদনান। ‘প্রিয়তমা, এখন গভীর রাত। পৃথিবীর মানুষগুলো সুপ্তির সঘন আয়েশে। ঠিক এই সময়ে আমার দু’চোখে ঘুম নেই...।’

এভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভালোবাসার কথাটি প্রকাশ করেছিলেন তিনি। চিঠি গেল রোজির মাধ্যমে নাজনীনের কাছে। কিন্তু এক, দুই, তিন করে দিন যায়- ফেরত চিঠি আসে না। ঘুম নেই আদনানের চোখে। লেখাপড়ার বারোটা বাজছে। খাবার খাওয়া হচ্ছে না ঠিকমতো। রোজিও কিছু জানাচ্ছে না। রাস্তায় নাজনীনকে দেখলে যেন ভয় পায় আদনান। তাকে দেখলেই পালিয়ে অন্য রাস্তায় চলে যায়। এভাবে বেশ কিছুদিন কাটার পর হলুদ খামে চিঠি আসে। এক পৃষ্ঠার রঙিন কাগজে। নানা কথা। সঙ্গে ফুলের কয়েক পাপড়ি। চিঠির দুই পাশে লাল কালিতে আঁকা গোলাপ ফুল।

আদনান বলেন, তার চিঠিতে অনেক বানান ভুল ছিল। কিন্তু চিঠিটি আমার কাছে এতো প্রিয় ছিল যে হাতে পেয়ে মনে হলো আকাশের চাঁদ পেয়েছি। রাতে ঘুমানোর আগে এটি পড়ে ঘুমাতাম। বুকের মধ্যে রেখে এক অন্যরকম অনুভূতি নিতাম। তারপর আরো অনেক চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রেম হওয়ার পর দেখা হলো স্কুলের পাশের একটি রাস্তায়। দুজন হাঁটছি।

মাথা নিচু করে। কথা বলছি পরীক্ষা, লেখাপড়া নিয়ে। প্রেমের কোনো কথা নেই। আরো অনেক পরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভালোবাসার কথাটি বলতে পেরেছেন তারা। দীর্ঘ সাত বছর প্রেম করেছেন। শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। বিয়ে করার তীব্র ইচ্ছে ছিল তাদের। কিন্তু মা-বাবার অমত থাকায় এখন দুজনেরই আলাদা সংসার। যোগাযোগ নেই তাদের। তবে আদনান চান, তার প্রিয়তমা সুখে থাক সবসময়।

একই সময়ের আরেক প্রেমিকের নাম রাকিব। রাকিব যাকে ভালোবাসতেন কোনোভাবেই মেয়েটি তাকে গ্রহণ করছিলো না। মেয়েটির মন পেতে বেছে নেন অভিনব পদ্ধতি। ডান হাতে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে নাম লিখেন মেয়েটির। তাতে মন গলে না মেয়ের। চিঠির পর চিঠি লিখেন। উত্তর নেই। এক পর্যায়ে আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে লিখেছিলেন ‘আই লাভ ইউ।’ অতঃপর তার সঙ্গে প্রেম হয়েছিলো তার। কিন্তু প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রে রক্ত, এসিডের ব্যবহার তখনও বোদ্ধারা ভালো চোখে দেখতেন না।


রাজধানীর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিক রায়হান ও রিয়া। প্রেমিকা শব্দটা ব্যবহার করেন না অনিক। তিনি বলেন, গার্লফ্রেন্ড। তার গার্লফ্রেন্ড রিয়া। রিয়ার সঙ্গে ছিল বন্ধুতা। দুজনেই ঘুরে বেড়ান। গল্প করেন। আস্তে আস্তে মনে হলো রিয়াকে ভালোবেসেছেন তিনি। ব্যস সিদ্ধান্ত নেন তাকে বলতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ডাকেন রিয়াকে। রেস্টুরেন্টের কর্ণারে তখন আবছা অন্ধকার। অনিক মোমবাতি প্রজ্বালন করেন। আলো জ্বলে উঠে। মৃদু আলো। রিয়া অবাক হন। ক্যান্ডের লাইট ডিনারে মোমবাতির আলো-আঁধারি পরিবেশ। বাজছে রোমান্টিক মিউজিক।

এরমধ্যেই রিয়ার হাতটি বুকের সঙ্গে টেনে ধরেন। বলেন, লাভ ইউ রিয়া। এভাবেই শুরু। এখন তারা ফেসবুকে যৌথ ছবি দেন। দুজন-দুজনকে জান, জানু বলে সম্বোধন করেন। বিষয়টি তাদের ঘনিষ্ঠরা সবাই জানেন। একইভাবে ইংরেজি মাধ্যমের এক ছাত্রী ভালোবাসেন তার ক্লাসমেটকে। দেশের বিভিন্নস্থানে ঘুরে বেড়ান তারা। কিছুদিন আগে প্রেমিক ছেলেটি অসুস্থ হয়। ‘আমার বয়ফ্রেন্ড অসুস্থ, দোয়া চাই’ বলে তখন ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন।

সঙ্গে তাদের দু’জনের ছবি। এই প্রেমিক জুটির কাছে বিয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, বিয়ে নিয়ে ভাবছেন না তারা। লেখাপড়া শেষ করতে হবে। কর্মজীবন শুরু করার পরে এ বিষয় নিয়ে ভাববেন। ফেসবুকে সম্পর্কের বিষয়টি প্রচারের ফলে আত্মীয়স্বজনরা জানায় সমস্যা হয় কি-না জানতে চাইলে তারা জানান, প্রেমের বিষয়টি মা-বাবা সবাই জানেন।

এইভাবে অনেকের প্রেমের সম্পর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। আসিফ হাসান ও মৌলি। দুজনেই দুজনকে চিনতেন না। আসিফ লেখালেখি করেন। লেখা পড়েই ভক্ত হন মৌলি। মাঝে-মধ্যে চ্যাট হতো দুজনের। রাতের চ্যাটে অন্যরকম ভাব প্রকাশ হতো। তারপর ইমোতে কথা হয় দুজনের। ইমোতে-ফোনে। দেখাদেখির আগেই দুজন-দুজনের প্রেমে জড়িয়ে যান। গভীর প্রেমে।

একদিন কথা না হলে যেন প্রাণ থাকে না প্রাণে। অতঃপর দেখা হয় একদিন। তারপর থেকে দুজনেই হারিয়ে যান। কাছে, দূরে। ঘরে, বাইরে প্রজাপতির মতো উড়তে থাকেন তারা। বিয়ে করবেন এমনটি ভাবেননি। তবে এক পর্যায়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন দুজন। কিন্তু সকল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম থাকে না। তাই বিয়ের চেয়ে প্রেমটাই তাদের কাছে বড়। তারা চান প্রেম থাকা উচিত সবসময়। বিশেষ দিনে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান একে-অন্যকে। গিফট আদান-প্রদান হয়। বেড়াতে যান। একদিন ঠিকমতো দেখা-কথা না হলে একে-অন্যের প্রতি রেগে যান।

তাদের ভাষায় ‘ভালোবাসা এরকমই হয়।’ ২০১৫ সালের একটি ডিজে পার্টিতে নাচতে নাচতেই এক সংগীত শিল্পী প্রেমের প্রস্তাব দেন এক তরুণীকে। ওই তরুণী জানান, তার সঙ্গে আগে কখনও সেভাবে কথা হয়নি। নাচতেই নাচতেই তিনি বলেন, ‘উইল ইউ মেরি মি?’ তরুণীও সাড়া দেন। ছুটিয়ে প্রেম করেন কয়েক মাস। তারপর ওই সংগীত শিল্পী অন্য ঘাটে নোঙর পেলেন। ওই তরুণীও হাত রাখেন অন্য হাতে। এ নিয়ে কোনো কষ্ট নেই তাদের। তরুণীর ভাষায় ‘মন বদলাতে পারে। পছন্দ বদলাতে পারে। এটি নিয়ে ভাবি না।’
Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment