দুই খুনের নেপথ্যে আ.লীগ নেতাদের অবৈধ আয়

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রহিমপুর গ্রামের দক্ষিণপাড়া এলাকায় মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের দুই উপগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন নিহত ও কয়েকজন গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার নেপথ্যে এলাকায় দলটির প্রভাবশালী দুই নেতার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ও দলীয় নেতাকর্মীদের অবৈধ আয়ের ভাগবাটোয়ারা কাজ করেছে বলে জানা গেছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দুগ্রুপের নেতাকর্মীরাই গোমতী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করতেন; বাসস্ট্যান্ড ও সিএনজি অটোস্ট্যান্ড থেকে চাঁদা আদায় করতেন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাবার সরবরাহকারীর কাছ থেকে বখরা আদায় করতেন। এসব অবৈধ আয়ের ভাগবাটোয়ারা থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।

সংঘর্ষের পর থেকে এলাকায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। আরও সংঘাতের আশঙ্কায় আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল বুধবার উপজেলা সদরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল আশরাফ গ্রুপের প্রধান আশরাফ প্রতিপক্ষের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করেছেন। মুরাদনগরে আওয়ামী লীগের বিবদমান এই দুুটি উপগ্রুপ স্থানীয় এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের সমর্থক। একটি উপগ্রুপের নেতৃত্বে আছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আলী আশরাফ, অন্যটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলাউদ্দিন আনিস। সংঘর্ষে নিহতরা হলেনÑ আশরাফ গ্রুপের খোরশেদ আলমের ছেলে ফারুক মিয়া (৩০) ও আবু হানিফের ছেলে সাইদুল ইসলাম (২২)। নিহত ফারুক সম্পর্কে আশরাফের চাচাতো ভাই ও সাইদুল আশরাফের ভাতিজা। সংঘর্ষে জড়িত ৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

এলাকাবাসী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুরাদনগর আওয়ামী লীগের বিবদমান মূল দুগ্রুপের নেতৃত্বে আছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকার। এ দুগ্রুপের রয়েছে বহু উপগ্রুপ। ক্ষমতায় থাকার কারণে ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন গ্রুপের উপগ্রুপগুলো এলাকায় বেশ সক্রিয় রয়েছে। উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারসহ নানা সেক্টর রয়েছে এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে গোমতী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি, বাসস্ট্যান্ড ও সিএনজি অটোস্ট্যান্ড থেকে চাঁদা আদায় ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাবার সরবরাহের মতো আর্থিক খাতগুলোও এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মধ্যে এসব খাতের বেশিরভাগই রয়েছে ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন গ্রুপের উপগ্রুপ ইউপি মেম্বার আলী আশরাফের নিয়ন্ত্রণে।

গত দেড় বছর ধরে আলী আশরাফ সব অবৈধ আয়ের খাত তার নিয়ন্ত্রণে রাখায় এবং সন্তোষজনক ভাগবাটোয়ারা না দেওয়ায় উপগ্রুপ থেকে বেরিয়ে আলাদা গ্রুপ করেন আলাউদ্দিন আনিস। একপর্যায়ে আলাউদ্দিন আনিসের নেতৃত্বাধীন উপগ্রুপ আশরাফের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতে রূপ নেয়। তারা আশরাফের নিয়ন্ত্রণে থাকা খাতগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎপরতা শুরু করে। ইতিপূর্বে বাজার ইজারাসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় আশরাফ গ্রুপ ও আলাউদ্দিন আনিস গ্রুপের মধ্যে কয়েকদফা সংঘর্ষ হয়েছে। ওই সব ঘটনার জের ধরে দুগ্রুপের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।

এরই জের ধরে মঙ্গলবার রাতে আলাউদ্দিন আনিস গ্রুপের লোকজন আলী আশরাফের বালু ব্যবসার ড্রেজার পরিচালনার কাজে নিয়োজিত লোকজনকে বাধা দেয়। খবর পেয়ে আলী আশরাফ মেম্বার, ফারুক ও সাইদুলসহ তাদের লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছলে আলাউদ্দিন আনিস গ্রুপের লোকজন তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।

পুলিশ সূত্র জানায়, একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আশরাফ গ্রুপের আলী আশরাফ, ফারুক, সাইদুর, রুবেল, আবুবক্করসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়। স্থানীয়রা তাদের মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা সাইদুর ও ফারুককে মৃত ঘোষণা করেন। সংঘর্ষের সময় কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে দুজন নিহতের খবরে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

এ ব্যাপারে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন জানান, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা নিয়ে বিরোধের জের ধরে রাতে স্থানীয় ইউপি সদস্য আলী আশরাফ ও আলাউদ্দিন আনিস গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ফারুক ও সাইদুর নামে দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম বদিউজ্জামান জানান, এ ঘটনায় আহত ইউপি সদস্য আলী আশরাফ বাদী হয়ে ২৯ জনের নামোল্লেখ ও ২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

এ ঘটনায় কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার এক বিতৃতিতে বলেছেন, মুরাদনগরের সংঘর্ষ দলীয় কোনো বিষয় নয়। নিহতরাও আওয়ামী লীগের কেউ নন। তারা এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের অনুসারী। তারা মূলত বিএনপি-জামায়াতের লাঠিয়াল বাহিনী। স্থানীয় এমপি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে ওই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মাসুদ গং। তারা পুরো এলাকায় মাদক, ভূমি দখল, টেন্ডারবাজিসহ হেন অপকর্ম নেই, যা করে না। আমরা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করছি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেলফোনে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment