চুরিবিদ্যা বিষয়ে আমি যতটুকু জানি


'কালের খেয়া'র কবি মাহবুব আজীজ কোনো এক বিচিত্র কারণে আমার ওপরে গোস্বা করেছেন। তিনি যে আমার ওপরে রাগ করে আছেন, তা আমার জানা ছিল না। তিনি আমার বিশেষ রকমের স্নেহভাজন। আমি তার কবিতাকর্ম ও অন্যান্য সাহিত্যকর্মের অনুরাগী অনুসারী। কাজেই আমার জানবার কথা নয় যে, তিনি আমার ওপরে রাগ করে আছেন। শিল্পীর ক্রোধ কিংবা অভিমান, তা শিল্পিত হতে বাধ্য। তার প্রতিশোধও হবে শিল্পসুষমাদীপ্ত। তিনি প্রতিশোধের এক অপরূপ উপায় আবিষ্কার ও প্রয়োগ করলেন। একদিন ফোন করে আমাকে বললেন, আনিস ভাই, একটা লেখা দিতে হবে, বিষয় 'চুরি'। সাধু ভাষায়- তস্করবৃত্তি। তখনই আমি বুঝে ফেললাম তার মতলবটা।

যে কোনো সংবাদপত্রের বার্তাকক্ষে রাতের শিফটে চলে তুঘলকি কাণ্ড। সময়ের সঙ্গে ছুটছে সবাই। সারা দেশ থেকে নিউজ আসছে, আসছে সারা পৃথিবী থেকে। একেকজনকে একেকটা খবর সম্পাদনা করার দায়িত্ব দিচ্ছেন বার্তা সম্পাদক আর শিফট ইনচার্জরা [বাংলায় পালাপ্রধান]। কাউকে হয়তো দেওয়া হয়েছে অ্যাক্সিডেন্টের খবর, কাউকে দেওয়া হয়েছে খুনের খবর, কাউকে বা ধর্ষণের খবর। কেউ ব্যস্ত রাজনীতি, কেউবা ধর্মঘট নিয়ে।

একটু পরপর নিউজ এডিটর তাগাদা দিচ্ছেন- এই, অ্যাক্সিডেন্ট কে করছে?
শামসু ভাই।
গুড। শামসু, তাড়াতাড়ি করো। রাগী বার্তা সম্পাদক গলা আরও চড়িয়ে বললেন, ধর্মঘট কে করছে?
অমল করছে, ভাই।
এই অমল, তাড়াতাড়ি করো।
এই, রেপ, কে করছে?
আমি করছি ভাইয়া। শাহিন নামে একজন হয়তো কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে মাথা তুলল।
বার্তাকক্ষে এটা নিয়ে কেউ হাসবে না। সবাই জানে, রেপ করছে মানে রেপের নিউজ অনুবাদ বা সম্পাদনা করছে শাহিন।
মার্ডার কার হাতে?
জি, আমার হাতে।
তুমি মার্ডার করছ?
কে করতে বলেছে?
জি, সোহরাব ভাই তো মার্ডারটা আমার হাতেই ধরিয়ে দিল।
দিয়েছে যখন, মার্ডার তাড়াতাড়ি করো।
এখন আমি বুঝতে পারছি, মাহবুব আজীজকে তার সম্পাদক জিগ্যেস করছেন, তোমার অগ্রগতি হলো কতটা? নেক্সট সংখ্যার প্রিপারেশন কেমন?
প্রিপারেশন খুব ভালো ভাই।
চুরিটা কে করছে?
চুরি? আনিস ভাই করছেন।
এ ছাড়া আমি সব সময় কম্পিউটারে একটা লেখা লিখে ফাইলের নামে নিজের নাম দিয়ে দিই। যেমন, প্রেম আনিস সমকাল। এর মানে হলো, প্রেম নিয়ে লেখা। লিখেছেন আনিস, আর এটা যাবে সমকালে। যাতে পত্রিকার লোকেরা ফাইলটা ডাউনলোড করার পর দ্বিধান্বিত না থাকে যে এটা কার লেখা।

আমার এই ফাইলের নাম তাই হওয়া উচিত- চোর আনিস সমকাল। আমি বুদ্ধি করে নামটা পাল্টে দিয়েছি। নাম দিয়েছি, চোর মাহবুব আজীজ আনিস।

চুরি নিয়ে, চোর নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অমর সব লেখা আছে।

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় একটা বই ছিল- নিশিকুটুম্ব, মনোজ বসু। বইটার আগোগোড়া কিছুই মনে নাই, শুধু এতটুকু মনে আছে, বর্ণনা ছিল খুবই সরস, রম্যতার গুণে রঙিন। বইটা নাকি একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিল।

আরেকটা গল্প খুব বিখ্যাত। কিন্তু লেখকের নাম মনে নাই। পাশের বাড়িতে চোর ধরা পড়েছে। মহা হৈচৈ। এক শিশুর মহাকৌতূহল, সে চোর দেখতে যাবে। শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো চোর দেখাতে। দেখার পরে সে হতাশ। বলল, চোর কই! ও তো মানুষ।

হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত গল্প 'চোখ।' এটাও চোর নিয়ে লেখা। একটা চোর ধরা হয়েছে। তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। তার চোখে খেজুর কাঁটা ঢুকিয়ে চোখ নষ্ট করে ফেলা হবে। এই গল্পের প্রশংসা করে কলাম লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। গল্পটা যথারীতি হুমায়ূন আহমেদীয় মমতা আর জাদু দিয়ে শেষ হয়...

"আজান হচ্ছে। আসর ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মতি অনেক কষ্টে পাশ ফিরল। তারা চোখ কখন তুলবে? নামাজের আগে নিশ্চয়ই না। কিছু সময় এখনও হাতে আছে। এর মধ্যে কত কিছু হয়ে যেতে পারে। মহাখালী রেলস্টেশনে সে একবার ধরা পড়ল। তাকে মেরেই ফেলত। ট্রেনের কামরা থেকে একটা মেয়ে ছুটে নেমে এলো। চিৎকার করে বলল, আপনারা কি মানুষটাকে মেরে ফেলবেন? খবরদার আর না। খবরদার। মেয়েটির মূর্তি দেখেই লোকজন হকচকিয়ে গেল। লোকজনের কথা বাদ থাক, সে নিজেই হতভম্ব। জীবন বাঁচানোর জন্যে মেয়েটিকে সামান্য ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এই মেয়ে চলে গেছে কোথায় না কোথায়।

আজ এই যে এত লোক চারপাশে ভিড় করে আছে, এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আছে ওই মেয়েটির মতো। সে অবশ্যই শেষ মুহূর্তে ছুটে এসে বলবে, 'করেন কী! করেন কী!' আর এতেই মতির নয়ন রক্ষা পাবে। এইটুকু বিশ্বাস তো মানুষের প্রতি রাখতেই হবে। মতি মিয়া অপেক্ষা করে। কে হবে সেই লোকটি। না জানি সে দেখতে কেমন। এই লোকটির চোখ কি ট্রেনের মেয়েটির চোখের মতো মমতামাখা হবে? যে চোখের দিকে তাকালে ভালো হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মতি মিয়া চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে তার ভালোই লাগে।"

রবীন্দ্রনাথ কি চোর বা চুরি নিয়ে কিছু লিখেছেন? কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, আমরা সবাই জানি- লিচুচোর। ছোটবেলায় এই কবিতা আমরা সবাই পড়েছি, আর স্কুলের প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করেছি। কবিতাটার একপর্যায়ে 'পড়েছি সড়াত জোরে' বলবার সময় অনেকেই নিজেই ধপাস করে পড়ে গিয়ে বাচনিক প্রতিযোগিতাকে শারীরিক কসরতেও উন্নীত করেছি।

রবীন্দ্রনাথের চুরি সম্পর্কিত লেখার কথা মনে করতে চাইলে আপনাআপনি এসে যায়- যা-কিছু হারায়, গিনি্ন বলেন, 'কেষ্টা বেটাই চোর।' 'পুরাতন ভৃত্য' কবিতার এই লাইনটা। কিংবা 'দুই বিঘা জমি'। উপেনের দুই বিঘা জমি ভূস্বামী প্রায় জোরজবরদস্তি করেই কেড়ে নিলেন। উপেন দিতে চায়নি। তাকে মিথ্যা দেনার ফেরে ফেললেন বাবু, তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করলেন। সেখানেই উপেনের সেই ভুবনবিখ্যাত উপলব্ধি-

এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি-

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

নিজের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছন্ন হয়ে উপেন একদিন ফিরে এসেছে তার দুই বিঘা জমিতে। খুব তার ইচ্ছা হচ্ছিল নিজের প্রাণপ্রিয় জমিটুকুন দেখবার। তার আমগাছ ছিল। আমগাছের নিচে দুটো আম পড়ে আছে। সে দুটো সে কুড়িয়ে নিয়েছে। তার মনে পড়ছে- ছোটবেলায় কতই না সে আম কুড়াত ঝড়ের দিনে! তখনই মালী এসে ধরে নিয়ে গেল তাকে, বাবুর কাছে।

আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।'
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
রবীন্দ্রনাথ আত্মপরিচয় ২ প্রবন্ধে বলছেন,

'অহংটাই পৃথিবীর মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো চোর। সে স্বয়ং ভগবানের সামগ্রীও নিজের বলিয়া দাবি করিতে কুণ্ঠিত হয় না। এইজন্যেই তো ঐ দুর্বৃত্তটাকে দাবাইয়া রাখিবার জন্য এত অনুশাসন। এইজন্যই তো মনু বলিয়াছেন- সম্মানকে বিষের মতো জানিবে, অপমানই অমৃত। সম্মান যেখানেই লোভনীয় সেখানেই সাধ্যমত তাহার সংস্র্রব পরিহার করা ভালো।'

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটা গল্প আছে। ঠিক মার্কেজের নয়, 'কেমন করে গল্প হয়' নামে একটা চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখার কর্মশালা পরিচালনা করেছিলেন মার্কেজ, সেখানে একজন অংশগ্রহণকারী, তার নাম কনসোয়েলা গারিদো, তিনি লিখে জমা দিয়েছিলেন এই গল্পটা। নাম 'শনিবারের চোর।' এই গল্পে একটা চোর চুরি করতে যায়। সেখানে এক নারীকে তার ভালো লাগে, নারীটিরও ভালো লাগে ওই চোরটাকে। চোর সব চুরির মাল ফেরত দিয়ে উপদেশ দেয় নারীটিকে- কী করলে চোররা আর চুরি করতে পারবে না। তখন নারীটি চোরকে বলে, সামনের সপ্তাহে গৃহকর্তা বাড়ির বাইরে রাত কাটাবেন, সে যেন সেই রাতে আবার আসে।

কিন্তু আমার মনে আছে, আমি মার্কেজের নিজের লেখা একটা গল্প পড়েছি, যাতে একটা চোর চুরি করে আসার পর অনুতপ্ত হয়, সে চুরির মাল ফেরত দিতে যায়। মাল ফেরত দিতে গিয়ে সে ধরা পড়ে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে নামটা, এই শহরে আর কোনো চোর নেই। দেয়ার আর নো থিভস ইন দি টাউন। এখন ওই গল্পে ঠিক এটাই ঘটে কি-না, তা আর নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কারণ এখন আমার বুকশেলফ ঘেঁটে দেখছি, মার্কেজের কালেক্টেড স্টোরিজ বইটা নেই। বই ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়াকে কেউ চুরি বলে না।

চোর নিয়ে আমারও গল্প আছে। একটা তো ছোটদের জন্য লেখা- 'প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আমাদের বাসায় চোর আসে।' আরেকটা হলো 'চক্র'। চোর চুরি করতে গেছে, তার ঘরে বউ একা। এ সময় একজন ঢুকে পড়ে তার ঘরে, যে জানে চোর আজ রাতে চুরি করতে বেরুবে, আর চোরও যায় তারই বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখে অন্য আরেকজন ঢুকেছে এই ঘরে, গৃহকর্তার স্ত্রী তখন একা...

চুরি নিয়ে খুব সুন্দর গল্প পড়েছিলাম আলবার্তো মোরাভিয়ার। একজন চোর সোনার দাঁত চুরি করতে যায় গোরস্তানে... কী সব গল্প! গরিব মানুষদের নিয়ে মোরাভিয়ার গল্পগুলো ভোলা যায় না।

তাহলে আমার লেখা একটা ছড়াই না হয় পড়ূন :
আমি যেদিন থাকব না, কেউই কিছু বুঝবে না,
চলবে সবই নিয়মমাফিক, আমাকে কেউ পুছবে না।
আস্ত রবি অস্ত যাবে, উঠতে পারে সন্ধ্যাতারা;
যাদের টাকা ধার করেছি, কিছুটা ধার ধারবে তারা।
যারা আমার লোন নিয়েছেন, তারা যাবেন দিব্যি চেপে,
১১ পাতায় খবর হবো, আড়াই ইঞ্চি জুটবে মেপে।
আধা কলাম ছবির নিচে ক্যাপশনে ঠিক তিনটা ভুল,
আনিসুল হক ছাপা হবে কেউবা লিখবে আনিছুল।
আমার ঘরে চলবে টিভি, হিন্দি সিরিজ থামবে না,
চড়ই করবে কিচিরমিচির, তারা কিছুই জানবে না।
আমি কারও বন্ধু ছিলাম, আমার তো তা হয় না মনে,
বন্ধুকৃত্য করবে না কেউ, রইব পড়ে সুনির্জনে।
ভাবছি একটা দাঁত বাঁধাব, বাইশ ক্যারাট স্বর্ণ মুড়ে,
মরার পরে নেবেন তিনি, উড়ে যিনি বসেন জুড়ে।
সোনার লোভে কেউ না আসুক, গোরের পাশে আসবে চোরে,
পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, তাহার চিহ্ন রইবে পড়ে।
ফরাসি কবি পিয়েরে কার্ডিনালের একটা কবিতা আছে এই রকম :
একজন ভিক্ষুক যদি লাগাম চুরি করে,
তবে তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে সে, যে ঘোড়া চুরি করেছে।
এই দুনিয়ার ন্যায়বিচারের এইটাই নিয়ম, ধনী চোরেরা গরিব চোরকে ঝুলিয়ে দেবে।'

আর টিএস এলিয়টের সেই বিখ্যাত তুলনাটাও তো আমাদের মনে পড়বে, যেখানে তিনি বলেছেন, 'কাঁচা কবিরা নকল করে, পাকা কবিরা চুরি করে।' পাকা কবিরা কী করেন, করেন সেই চোরের মতো, যে কি-না এক খণ্ড মাংস রেখে দেয় কুকুরের জন্য, কুকুর সেই মাংসের কাছে চলে যায়, চোর গৃহে প্রবেশ করে। কবিরাও তেমনি, কোনো একটা বাগ্ধারা আত্মসাৎ করেন, কিন্তু সেটা তিনি রেখে দেন পাঠকদের সামনে, আর নিজে চলে যান অন্য কোথাও।

শেকসপিয়রের উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখা শেষ করব। ওথেলো নাটকে শেকসপিয়র বলছেন, চুরি হওয়ার পরেও যিনি হাসতে পারেন, তিনি চোরের কাছ থেকে কিছু একটা চুরি করতে পারেন, আর যে কি-না চুরি হয়ে গেছে বলে বিলাপ করে, সে তার নিজেকেই চুরি করে, বিনিময়ে অসীম দুঃখকেই সে কেবল ডেকে আনে।



মাহবুব আজীজ আমাকে 'চুরি' সম্পর্কে লিখতে বলেছেন বলে তাই দুঃখ করি না। দুঃখ না করে হাসি। তাতে বরং লাভই হবে। দুঃখ করলে তা ডেকে আনবে অনন্ত দুঃখকেই।
                                                      লেখক ; আনিসুল হক ।
Share on Google Plus

About Unknown

0 comments:

Post a Comment