বিশ্ব ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রাটি প্রথম যাত্রা করে ১৯৮৯ সালে। প্রথম বছরেই নববর্ষ উৎসব উদ্যাপনকারীদের নজর কেড়ে নেয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। এর পর থেকে এটা বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো এই শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
জানা যায়, এবার ভিন্ন আবহ থাকবে শোভাযাত্রায়। প্রথমত, এর মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হবে বিশ্ব-স্বীকৃতি। পাশাপাশি সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হবে প্রতিবাদ। অসুন্দরের বিরুদ্ধে, অমঙ্গলের বিরুদ্ধে এবার শোভাযাত্রার মূল থিম ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’।
রবিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে ঘুরে দেখা যায় নতুন বাংলা বছর বরণের নানামুখী তৎপরতা। শিল্পাচার্য জয়নুলের স্মৃতিময় আঙিনায় উৎসবের আমেজ। বাঙালির প্রাণের উৎসবকে বরণ করতে তৈরি হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা প্রতীক, তৈরি হচ্ছে রং-বেরঙের মুখোশ। তাতে লেগেছে শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়। বিপুল উৎসাহ নিয়ে শোভাযাত্রার কাজ করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে কল্যাণের বারতা দেওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্ব।
নিরলস কাজ করে চলেছেন শিক্ষার্থীরা। জয়নুল গ্যালারির সামনেই তৈরি হচ্ছে বৃহৎ আকারের নানা মুখোশ। বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাখি। তৈরি হচ্ছে বিশাল আকৃতির নানা শিল্প-কাঠামো। তার জন্য আনা হচ্ছে বাঁশ, বেত ও অন্যান্য সরঞ্জাম।
আয়োজকরা জানান, অন্ধকারের বিরুদ্ধে এবার থাকছে নানা মোটিভ, থাকছে নানা শৈল্পিক প্রতিবাদ। শোভাযাত্রায় অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে থাকছে সূর্যের মুখের কাঠামো। অন্ধকার তাড়াতে যেন আলোয় ভরে ওঠে পৃথিবী।
একপাশে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকাআঁকির দৃশ্য। শোভাযাত্রার ব্যয় মেটাতে চারু-শিক্ষার্থীরা টেবিলে ছড়িয়ে দিয়েছেন রঙের কৌটা। সেগুলো থেকে রং তুলে চলছিল চিত্রকর্ম সৃজন। এই শিল্প সৃজনের মাঝেই কথা হলো অনুষদের অঙ্কন বিভাগের শিক্ষক শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর সঙ্গে। জানালেন, প্রতিবছরের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রার খরচ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নিজেদের শিল্পকর্ম বিক্রি করে সংগ্রহ করবেন। আর সে পর্বের সূচনা করেছেন অধ্যাপক রফিকুন নবী। তিনিসহ অধ্যাপক সৈয়দ আবুল বারক্্ আলভী, শিশির ভট্টাচার্যও ছবি এঁকেছেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা এঁকেছেন সরাচিত্র। একদিকে সেসব বিক্রি হচ্ছে, অন্যদিকে বিক্রিলব্ধ অর্থ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা অনুষঙ্গ।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে চারুকলা অনুষদের ১৮ ও ১৯তম ব্যাচ। মুখোশ, সরাচিত্র, চিত্রকর্ম, শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামো প্রভৃতি অনুষঙ্গ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এসব ব্যাচের শিক্ষার্থীদের। ভাগাভাগি করা এই কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সাগর হোসেন সোহাগ, পলাশ সাহা, আরিফ সিদ্দিকী নিটোল, সবুজ দাস প্রমুখ।
বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, ‘যেহেতু মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তাই এবারের আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করার প্রচেষ্টা থাকবে। আশা করছি, এবারের শোভাযাত্রাটি আরো বর্ণাঢ্য ও বিস্তৃত হবে। সর্বসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও বাড়বে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার পরও নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে অতিক্রমের চেষ্টা রয়েছে। ’
আগামী ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতি অনুষ্ঠান শেষে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ আর বিশাল আকৃতির সব বাহন নিয়ে এই শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে বের হয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল (সাবেক রূপসী বাংলা) চত্বর ঘুরে আবারও চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে।
0 comments:
Post a Comment